পোস্ট আপডেট ০৪ মে ২০২৫ ২ সপ্তাহ আগে
বাংলাদেশের হৃদয়জুড়ে রয়েছে তার অসংখ্য গ্রাম। ছোট ছোট গাছগাছালি ঘেরা, সরল মানুষে ভরা এই গ্রামগুলোই বাংলার সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, কৃষি ও জীবনধারার মূল ভিত্তি। শহরের কোলাহল থেকে অনেক দূরে, শান্ত পরিবেশে অবস্থিত গ্রামগুলো আমাদের প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগ ঘটায়।
একটি গ্রামের প্রকৃতি তার সবচেয়ে বড় সম্পদ। সবুজ ধানক্ষেত, পাখির ডাক, কাঁচা রাস্তা, পুকুরপাড়—সব মিলিয়ে এক অপার সৌন্দর্যের সৃষ্টি করে। সকালে মেঘলা আকাশের নিচে মাঠের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাওয়া কিংবা বিকেলের সোনালি রোদে নদীর পাড়ে বসে থাকা—এই সবই গ্রামীণ জীবনের চিরচেনা ছবি।
বাংলাদেশের প্রকৃতির সৌন্দর্য মূলত তার গ্রামীণ এলাকাতেই সবচেয়ে বেশি ফুটে ওঠে। দেশের প্রায় ৬৫% মানুষ এখনও গ্রামে বসবাস করে এবং তারা এই প্রকৃতির ছায়াতলে জীবনযাপন করে আসছে যুগ যুগ ধরে। ধানক্ষেত, খাল-বিল, সবুজ বনের শোভা, পাখির কাকলি, গ্রামীণ জীবনের সরলতা—এসব মিলেই গড়ে উঠেছে গ্রামীণ প্রকৃতির এক অদ্বিতীয় রূপ।
বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে সবুজ ধানক্ষেত। বর্ষা, হেমন্ত, ও শীতকাল মিলিয়ে বছরে তিনবার ধান চাষ হয়। বিশেষ করে আমন, আউশ, ও বোরো এই তিন ধানের জাত গ্রামীণ কৃষির প্রধান ভিত্তি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (BBS 2023) মতে, দেশের মোট কৃষিজমির ৭৫% ধান চাষের অধীনে রয়েছে।
গ্রামীণ প্রকৃতিতে নানা ধরনের পাখি, প্রজাপতি, জলজ প্রাণী এবং গবাদি পশুর উপস্থিতি দেখা যায়।
দোয়েল (জাতীয় পাখি),
শালিক, বাবুই, মাছরাঙা
গাঙচিল ও বক পাখি বিল-ঝিল ও খালের ধারে দেখা যায়।
এছাড়াও মাছ ধরার সময় প্রায়শই দেখা যায় দেশি পুঁটি, শিং, মাগুর, কৈ ইত্যাদি মাছ।
গ্রামে তালগাছ, খেজুরগাছ, নারিকেল গাছ, কাঁঠাল, আম, জামরুলের মত ফলের গাছ ছাড়াও রয়েছে বহু ঔষধি গাছ।
তুলসী: সর্দি-কাশির উপশমে
বহেরা, হরীতকি, আমলকি: আয়ুর্বেদিক ওষুধে ব্যবহৃত
নিম গাছ: জীবাণুনাশক হিসেবে পরিচিত
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। গ্রামে ছোট-বড় শত শত খাল-বিল এবং নদী রয়েছে। গ্রামের মানুষ মাছ ধরা, সেচ কাজ ও যাতায়াতে এই জলপথ ব্যবহার করে।
2022 সালের তথ্যমতে, দেশের প্রায় ৪.৫ মিলিয়ন হেক্টর জমি জলাভূমি শ্রেণিভুক্ত (উৎস: Water Resources Planning Organization - WARPO)।
প্রকৃতির সেরা দৃশ্যগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো গ্রামের সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত। মেঘলা আকাশে লাল রঙে রাঙা হওয়া, গৃহস্থের খেতে কাজ শুরু করা, অথবা সন্ধ্যাবেলায় গরু ফিরে আসা—এসবই যেন একেকটি চিত্রকল্প।
গ্রামের মানুষ প্রকৃতির সাথে একান্তভাবে জড়িত। কৃষিকাজ, পশুপালন, হাঁস-মুরগি পালন, মৌচাষ, মাছ চাষ সবই প্রকৃতির অংশ হিসেবে এগিয়ে চলে। প্রাকৃতিক দুর্যোগেও তারা প্রকৃতির উপর নির্ভর করে টিকে থাকার চেষ্টা করে।
গ্রামীণ প্রকৃতি আজ নানা কারণে হুমকির মুখে। রাসায়নিক সার, প্লাস্টিক বর্জ্য, জলবায়ু পরিবর্তন, বৃক্ষনিধন ইত্যাদি কারণ গ্রামীণ পরিবেশকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘বিআইইসিএস’ এর মতে, গত ২০ বছরে গ্রামীণ এলাকায় ১৭% গাছপালা ধ্বংস হয়েছে।
জৈব সার ব্যবহারে উৎসাহ প্রদান
বৃক্ষরোপণ কার্যক্রম বৃদ্ধি
গ্রামের খাল-বিল পুনঃখনন
পরিবেশ শিক্ষা স্কুল পর্যায়ে বাধ্যতামূলক করা
স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা জোরদার করা
বাংলাদেশের গ্রাম প্রধানত কৃষি-নির্ভর। ধান, গম, পাট, সবজি চাষ গ্রামের মানুষের প্রধান জীবিকা। কৃষকরা ভোরবেলা কাজ শুরু করে, দিনশেষে ক্লান্ত হলেও তৃপ্ত। গৃহস্থালি কাজের পাশাপাশি গবাদিপশু পালন, হাঁস-মুরগির খামার এবং মাছচাষও গ্রামীণ জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
বাংলাদেশের কৃষি প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা যায়:
ফসল উৎপাদনভিত্তিক কৃষি
ধান, গম, ভুট্টা, আলু, ডাল ইত্যাদি
প্রাণিসম্পদ ভিত্তিক কৃষি
গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি, মহিষ পালন
মৎস্যচাষভিত্তিক কৃষি
পুকুরে মাছ চাষ, নদী ও বিলের মাছ ধরা
বাংলাদেশ কৃষি পরিসংখ্যান ব্যুরো (BBS 2023) এর তথ্যমতে, দেশের মোট কৃষিজমির পরিমাণ প্রায় ৮.৬ মিলিয়ন হেক্টর এবং বছরে ৩টি মৌসুমে ফসল উৎপন্ন হয়: রবি, খরিফ-১ এবং খরিফ-২।
কৃষকরা দিনের শুরু করেন সূর্য ওঠার সাথে সাথে। তারা জমিতে চাষাবাদ করেন, ফসল রক্ষা করেন, সেচ দেন, সার প্রয়োগ করেন এবং পরে তা সংগ্রহ করে বাজারজাত করেন।
অনেক কৃষক বাড়ির আঙিনায় শাকসবজি চাষ, হাঁস-মুরগি পালন এবং মৌসুমভিত্তিক ফুল কিংবা ফল চাষের সাথেও যুক্ত।
GDP-তে অবদান: প্রায় ১১-১৩%
রপ্তানি আয়ে অবদান: কৃষিপণ্য যেমন পাট, মাছ, আম, সবজি ইত্যাদি
খাদ্য নিরাপত্তা: কৃষির মাধ্যমে দেশে ধান, গম, ডাল, তেলবীজ, চিনি ইত্যাদির জোগান নিশ্চিত হয়
নারীর অংশগ্রহণ: প্রায় ৬০% গ্রামীণ নারী কৃষিকাজে যুক্ত (FAO, 2022)
বর্তমানে কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে:
ট্রাক্টর, পাওয়ার টিলার
সেচযন্ত্র
কীটনাশক স্প্রে মেশিন
মোবাইল অ্যাপস ও ডিজিটাল কৃষি তথ্যসেবা
"Krishi Call Center - 16123" হলো সরকারের ডিজিটাল কৃষি তথ্য হেল্পলাইন, যা কৃষকদের তথ্য ও পরামর্শ দিয়ে থাকে।
জৈব সার ব্যবহার, বিষমুক্ত সবজি উৎপাদন, এবং জমির উর্বরতা রক্ষা করার জন্য টেকসই কৃষির দিকে আগ্রহ বাড়ছে।
অনেক উদ্যোক্তা এখন "অর্গানিক ফার্মিং" শুরু করেছেন যা শুধু নিজের পরিবারের খাদ্য চাহিদাই নয়, বরং বাজারেও বিষমুক্ত পণ্যের চাহিদা মেটাচ্ছে।
বগুড়ার সবজি চাষি নজরুল ইসলাম – প্রতি বছর ৫ লাখ টাকার বেশি আয় করছেন বিষমুক্ত সবজি বিক্রি করে।
গোপালগঞ্জের মাছচাষি রাহেলা বেগম – ঘের চাষে প্রতিবছর প্রায় ৩ লাখ টাকা লাভ করেন।
কুমিল্লার নার্সারি মালিক জহিরুল – ফুল ও চারা বিক্রি করে বছরে ১০ লাখ টাকা উপার্জন করেন।
কৃষি উদ্যোক্তা হওয়া
কৃষি ভিত্তিক ই-কমার্স
কৃষি প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ সেবা
কৃষিভিত্তিক ছোট ছোট হোম-ইন্ডাস্ট্রি (আচার, মোরব্বা, গুঁড়া মসলা প্রভৃতি)
জলবায়ু পরিবর্তন ও বন্যা-খরা
কৃষি উপকরণের উচ্চমূল্য
মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য
ন্যায্য মূল্য না পাওয়া
তরুণদের কৃষিতে আগ্রহ কমে যাওয়া
আধুনিক কৃষি শিক্ষার প্রসার
কৃষককে সরাসরি ডিজিটাল মার্কেটিং সুবিধা
সরকারি ভর্তুকি ও সহজ ঋণ
জলবায়ু সহনশীল বীজ ব্যবহার
প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নারীদের আরও বেশি সম্পৃক্ত করা
গ্রামে মানুষ খুবই অতিথিপরায়ণ ও সহানুভূতিশীল। তাদের জীবন সহজ ও নির্ভেজাল। সমাজজীবন এখনো অনেকটা মিলেমিশে চলে। বিয়ে, পূজা-পার্বণ, ঈদ—সব উৎসব গ্রামে একত্রে পালন করা হয়। মানুষ একে অপরের খোঁজখবর রাখে, বিপদে-আপদে পাশে দাঁড়ায়।
বর্তমানে গ্রামের চিত্র অনেক বদলে গেছে। অনেক গ্রামে স্কুল, কলেজ, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, পাকা রাস্তা ও বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে। ইন্টারনেটও এখন অনেক গ্রামে পৌঁছে গেছে, ফলে শিক্ষার সুযোগ বেড়েছে। ছেলে-মেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে, অনেকে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়াশোনা করছে।
শহরের আধুনিকতার ছোঁয়া এখন গ্রামের দোরগোড়ায়। গ্রামের মানুষ এখন মোবাইল ফোন ব্যবহার করে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যুক্ত হয়। কিন্তু তারপরও তারা প্রকৃতির সান্নিধ্য এবং ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছে।
Copyright © NRS IT 2025