কোরআনের সুরা ইউসুফের ৫৩ নম্বর আয়াত থেকে সুরা ইবরাহিম পুরোটা তিলাওয়াত করা হবে।
ভিউ: ১৭৪
পোস্ট আপডেট ১০ মার্চ ২০২৫ ২ মাস আগে
আজ খতমে তারাবিহতে কোরআনের সুরা ইউসুফের ৫৩ নম্বর আয়াত থেকে সুরা ইবরাহিম সম্পূর্ণ তিলাওয়াত করা হবে। আজ ১৩তম পারা পাঠ করা হবে।
আজকের তিলাওয়াতে হজরত ইউসুফ (আ.)-এর জীবনের বিস্ময়কর ঘটনার শেষাংশ, তাওহিদের শিক্ষা, স্তম্ভহীন আকাশে আল্লাহর নিদর্শন, কোরআনের গৌরব, আল্লাহর জিকিরে অন্তরের প্রশান্তি, আল্লাহ সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা, জীবন ও মৃত্যু তাঁর হাতে, মুমিনদের গুণাবলি, কিয়ামতের অবস্থা, জাহান্নামের শাস্তি, নবী-রাসুলদের প্রতি অবিশ্বাসীদের আচরণ ও তাদের পরিণতি, সত্য-মিথ্যার পার্থক্য ইত্যাদি বিষয় উঠে আসবে।
কারাবন্দী থেকে অর্থমন্ত্রী
সুরা ইউসুফে হজরত ইউসুফ (আ.)-এর পূর্ণ জীবনীর ধারাবাহিক বিবরণ রয়েছে। গতকাল তারাবিহতে তাঁর জীবনের প্রথম অংশ তিলাওয়াত করা হয়েছিল। আজ তারাবিহর শুরুতে অবশিষ্ট অংশ পাঠ করা হবে।
মিসরের বাদশাহ স্বপ্নের সঠিক ব্যাখ্যা পেয়ে ইউসুফ (আ.)-কে কারাগার থেকে মুক্ত করতে চান। কিন্তু তিনি চাইলেন, আগে নির্দোষ প্রমাণিত হতে হবে। অবশেষে জুলেখা স্বীকার করেন, তিনিই মিথ্যা অপবাদ দিয়েছিলেন। এতে ইউসুফ (আ.)-এর সততা প্রমাণিত হয়। বাদশাহ তাঁর প্রজ্ঞায় মুগ্ধ হন। তখন ইউসুফ (আ.) মিসরের অর্থ বিভাগের দায়িত্ব গ্রহণের আবেদন করেন।
সেই সময় মিসর ও আশপাশের অঞ্চলে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ চলছিল। খাদ্যসংকটে তাঁর ভাইয়েরা বিশেষ অনুগ্রহের আশায় মিসরে আসেন। ইউসুফ (আ.) তাঁদের চিনলেও নিজের পরিচয় প্রকাশ করেননি। ভাইয়েরা তাঁকে একাধিকবার দেখেও চিনতে পারেননি।
একপর্যায়ে, ইউসুফ (আ.) একটি শর্ত দেন—ত্রাণ পেতে হলে তাঁদের ছোট ভাইকে সঙ্গে আনতে হবে। ছোট ভাই বেনিয়ামিন ছিলেন ইউসুফ (আ.)-এর সহোদর। বাবা হজরত ইয়াকুব (আ.) প্রথমে এতে রাজি হননি। কিন্তু চরম দুর্দশা ও ছেলেদের অনুরোধে শেষ পর্যন্ত অনুমতি দেন। এরপর ভাইয়েরা বেনিয়ামিনকে নিয়ে মিসরে আসেন।
ইউসুফ (আ.)-এর ছোট ভাইকে কাছে রাখা ও পরিবারের পুনর্মিলন
বেনিয়ামিনকে দেখে ইউসুফ (আ.) গভীর আত্মতৃপ্তি অনুভব করেন। তিনি কৌশলে তাকে নিজের কাছে রেখে দেন। বিদায়ের সময় ভাইদের হাতে নিজের পরনের জামা দিয়ে বলেন, ‘এটা আমার আব্বার চেহারার ওপর রেখো।’ পুত্রশোকে অন্ধ হয়ে যাওয়া হজরত ইয়াকুব (আ.) পুত্রের জামার সান্নিধ্যে দৃষ্টি ফিরে পান। পরে তিনি সপরিবারে মিসরে চলে আসেন এবং সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস করেন।
জুলেখার প্রেম ও পরিণতি
ইউসুফ (আ.)-এর সঙ্গে জুলেখার সম্পর্ক নিয়ে সমাজে নানা কথা প্রচলিত রয়েছে। বাস্তবে, এটি ছিল একপাক্ষিক ভালোবাসা—জুলেখা তাঁকে ভালোবেসেছিলেন, কিন্তু ইউসুফ (আ.) কখনো তাঁকে সেভাবে দেখেননি।
মুফাসসিরদের মতে, জুলেখার স্বামী কিতফিরের মৃত্যুর পর এবং তওবা করার পর ইউসুফ (আ.) তাঁর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁদের দুটি সন্তানও হয়েছিল (তাফসিরে ইবনে আবি হাতিম: ৮/৩৯০; তাফসিরে তবারি: ১৬/১৫১)। তবে কোরআন বা সহিহ হাদিসে এ বিষয়ে স্পষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায় না।
সুরা রাদ: বজ্রের প্রশংসা ও সত্য-মিথ্যার উদাহরণ
কোরআনের ১৩ নম্বর সুরা হলো সুরা রাদ, যার আয়াত সংখ্যা ৪৩। এটি মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে। ‘রাদ’ অর্থ বজ্র। এ সুরায় উল্লেখ রয়েছে যে বজ্রও আল্লাহর তাসবিহ পাঠ করে। বজ্র সম্পর্কিত আলোচনা থাকার কারণেই সুরাটির নাম সুরা রাদ রাখা হয়েছে।
সুরার সূচনাতেই তিনটি মৌলিক বিষয় আলোচিত হয়েছে—তাওহিদ (একত্ববাদ), রিসালাত (নবুওত), আখিরাত (পরকাল)
সুরা রাদের ১৭ নম্বর আয়াতে সত্য ও মিথ্যার প্রকৃতি বোঝাতে এক চমৎকার উদাহরণ দেওয়া হয়েছে।
মিথ্যা ও বাতিল জিনিসের উপমা হলো, ঢেউয়ের ওই বুদ্বুদের মতো, যা সাময়িকভাবে সবকিছু ঢেকে দেয়। কিন্তু অবশেষে বিলুপ্ত যায়।
সত্যপন্থীদের উপমা হলো, সেই সোনা-রুপার মতো, যা ঢেউয়ের সঙ্গে ভেসে যায় না; বরং জমিনে থেকে যায়। আগুনের সুষম তাপে খাঁটি সোনায় পরিণত হয়।
বুদ্ধিমানের ৮ গুণ
আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনের সুরা রাদ-এর ২০ থেকে ২৪ নম্বর আয়াতে প্রকৃত বুদ্ধিমান ও মুমিনদের ৮টি বিশেষ গুণ উল্লেখ করেছেন। যারা এই গুণের অধিকারী, তাদের জন্য জান্নাতের সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে।
প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা – তারা কোনো ওয়াদা করলে তা পূরণ করে।
আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা – পরিবার ও আত্মীয়দের সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষা করে।
আল্লাহকে ভয় করা – তারা সর্বদা আল্লাহর বিধান মেনে চলে।
পরকালের হিসাবের ভয় রাখা – তারা জানে যে, একদিন তাদের সমস্ত কাজের হিসাব দিতে হবে।
ধৈর্য ধারণ করা – তারা জীবনের প্রতিটি কঠিন মুহূর্তে ধৈর্য ধরে।
নামাজ কায়েম করা – তারা নিয়মিত নামাজ আদায় করে।
গোপনে ও প্রকাশ্যে দান করা – আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তারা খোলামেলা ও গোপনে দান করে।
দুর্ব্যবহারের প্রতিদান উত্তম আচরণ দিয়ে দেওয়া – তারা অপমানের বদলে ভালো ব্যবহার করে।
পবিত্র কোরআনের সুরা রাদ-এর ২৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তাআলা এমন তিন শ্রেণির মানুষকে দুর্ভাগা বলেছেন, যাদের প্রতি তিনি অভিসম্পাত (লানত) বর্ষণ করেন। এরা হলো:
প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী – যারা আল্লাহর সঙ্গে করা অঙ্গীকার ও চুক্তি ভঙ্গ করে।
সম্পর্ক ছিন্নকারী – যারা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করে, অথচ আল্লাহ বলেছেন, সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে।
পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টিকারী – যারা সমাজে বিশৃঙ্খলা ও ফিতনা ছড়ায়।
সুরা ইবরাহিম কোরআনের ১৪তম সুরা, যা মক্কায় নাজিল হয়েছে এবং এতে মোট ৫২টি আয়াত রয়েছে।
এই সুরায় হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর জীবন ও দোয়া সম্পর্কে বিশদভাবে আলোচনা করা হয়েছে।এই সুরা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মদিনায় হিজরতের কিছুদিন আগে নাজিল হয়।ইবরাহিম (আ.)-এর আকিদা, ঈমান, ত্যাগ ও আল্লাহর প্রতি নির্ভরতা—এসব বিষয় তুলে ধরা হয়েছে।
সুরা ইবরাহিমের ২৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তাআলা কালেমা তাইয়েবায় বিশ্বাসী মানুষ ও তার কাজের উদাহরণ একটি গাছের সঙ্গে দিয়েছেন, যার কাণ্ড মজবুত, সুউচ্চ এবং শিকড় মাটির গভীরে প্রোথিত। গাছটি এত শক্ত যে দমকা বাতাসে ভূমিসাৎ হয় না। এর ফল ময়লা ও আবর্জনা থেকে মুক্ত। এর শাখা উচ্চতায় আকাশপানে ধাবমান, ফল সব সময় খাওয়া যায়।
তাফসিরবিশারদের মতে, এখানে যে গাছটির উদাহরণ দেওয়া হয়েছে, তা হলো খেজুরগাছ। মুমিনের উদাহরণ হিসেবে এই গাছটি ব্যবহৃত হয়েছে, কারণ কালিমা তাইয়েবার মধ্যে মুমিনের ইমানের মতো শক্তিশালী ও স্থিতিশীল শিকড় থাকে। দুনিয়ার যে কোনো বিপদ বা সংকট ইমানকে কখনোই নড়াচড়া করতে পারে না, যেমন খেজুরগাছের শিকড় মাটি গভীরে প্রোথিত এবং গাছটি বিপদ থেকে অক্ষত থাকে।
সব যুগেই খাঁটি মুসলমানরা ইমানের মোকাবিলায় জীবন-সম্পদ ও কোনো কিছুর পরোয়া করেনি। মুমিনরা দুনিয়ার নোংরামি থেকে সব সময় দূরে থাকেন। মুমিনের সৎকর্ম আকাশের দিকে উত্থিত হয়। তাদের আমল সব ঋতুতে অব্যাহত রয়েছে। তাদের কথাবার্তা, ওঠাবসা সমগ্র বিশ্বের জন্য ফলদায়ক। (তাফসিরে মারেফুল কোরআন, পৃষ্ঠা: ৭১৬-৭১৭)
ইবরাহিম (আ.)-এর প্রার্থনায়
সুরা ইবরাহিমের ৩৫ থেকে ৪১ নম্বর আয়াতে হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর বিশেষ দোয়ার বর্ণনা এসেছে। ইবরাহিম (আ.) তাঁর দোয়ায় আল্লাহর কাছে তাঁর দেশ, সন্তান, এবং পরবর্তী বংশধরদের জন্য কল্যাণ ও সুকুমার জীবন কামনা করেছেন। তিনি চান, তাঁর সন্তানদের মধ্যে বিশ্বাস ও নামাজ প্রতিষ্ঠিত হোক, এবং তারা আল্লাহর উপাসনায় নিবেদিত হোক। তিনি আরও প্রার্থনা করেছেন, আল্লাহ যেন তাঁর সন্তানদের উত্তম রিজিক দান করেন এবং তাঁরা আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে সক্ষম হয়। এছাড়া, ইবরাহিম (আ.) তাঁর জন্য, তাঁর পিতা এবং সব মুমিনদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন।
এ সুরার শেষের দিকে কিয়ামত দিবসের ভয়াবহতা এবং জাহান্নামের কঠিন শাস্তির বর্ণনা রয়েছে, যা মানুষের দুনিয়াতে ভালো কাজ করতে এবং আল্লাহর আনুগত্যে থাকার গুরুত্বকে স্পষ্ট করে।
Copyright © NRS IT 2025