খাবারে বিষ মেশানো হয়েছে কি না চেনার ১৬টি উপায় – ঘরোয়া কৌশল, লক্ষণ ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা জেনে নিন
ভিউ: ৪৫
পোস্ট আপডেট ১৮ মে ২০২৫ ২১ ঘন্টা আগে
বর্তমান সময়ে খাদ্যে বিষক্রিয়া ও ভেজাল একটি মারাত্মক স্বাস্থ্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে বাজার থেকে কেনা মাছ, মাংস, দুধ, ফলমূল এমনকি সবজি পর্যন্ত ভেজাল ও বিষাক্ত রাসায়নিক দ্বারা দূষিত হতে পারে। তাই খাবারে বিষ রয়েছে কি না, তা চিহ্নিত করা ও যথাযথ প্রতিকার নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
এ প্রতিবেদনে আমরা জানব কীভাবে আপনি নিজেই খাবারে বিষ আছে কি না চিনতে পারেন – ঘরোয়া কৌশল থেকে শুরু করে আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি পর্যন্ত।
বিষাক্ত খাবার বলতে এমন সব খাবার বোঝায় যেগুলোতে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিক বা ব্যাকটেরিয়া রয়েছে। এগুলো খেলে তাৎক্ষণিক অথবা দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি হয়।
কিছু সাধারণ বিষাক্ত উপাদান:
ফরমালিন
কার্বাইড
কীটনাশক
সালফার
রঙিন কেমিক্যাল
কাপড় রঙ (ডাই)
অ্যারারোট
ইউরিয়া
সাবান-সোডা
দুর্ভাগ্যজনকভাবে ব্যবসায়িক লাভের উদ্দেশ্যে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ফল, সবজি, মাছ, দুধ, মাংসে বিষাক্ত রাসায়নিক ব্যবহার করে।
খাদ্যদ্রব্যের স্থায়িত্ব বাড়ানো
ফল ও শাকসবজি কৃত্রিমভাবে পাকানো
মাছ বা মাংসকে তাজা দেখানো
খাদ্যকে আকর্ষণীয় রঙে রূপান্তর করা
ফরমালিনযুক্ত খাবারে সাধারণত পিঁপড়া আসে না। মাছ বা মিষ্টি বাইরে রাখলে পিঁপড়া না এলে তা সন্দেহজনক।
খাদ্য যদি টক, ঝাঁঝালো বা কেমিক্যালজাত গন্ধ দেয়, তবে সেটি বিষাক্ত হতে পারে। প্রাকৃতিক খাদ্যে এমন গন্ধ সাধারণত থাকে না।
কৃত্রিম রঙ দেওয়া খাদ্যদ্রব্য যেমন চিপস, জিলাপি বা মিষ্টি – সেগুলো অতিরিক্ত চকচকে দেখালে সন্দেহ করুন।
কার্বাইড দিয়ে পাকানো আম, কলা, পেঁপে প্রভৃতি ফলের ত্বক অনেক সময় দাগহীন, শক্ত এবং চকচকে হয়।
ফরমালিন দেওয়া মাছ দেখতে চকচকে ও শক্ত হয়, কিন্তু গন্ধ হয় না। প্রাকৃতিক তাজা মাছের কিছুটা কাঁদামাটি বা মিষ্টি গন্ধ থাকার কথা।
অনেক সময় দুধে পানি বা কেমিক্যাল মেশানো হয়, ফলে তা বেশি ফেনা উঠে বা পাতলা হয়ে পড়ে। ফুটালে গাঢ়ভাবে জমে না।
খাবার খেয়ে যদি জিভে ঝাঁঝালো, তিক্ত বা পুড়ো স্বাদ লাগে, তবে সেটি বিষাক্ত হতে পারে।
খাবারে রূপার চামচ বা গয়না ডুবালে তা কালো হয়ে গেলে সেখানে সালফারজাতীয় কেমিক্যাল থাকতে পারে।
কোনো খাবার খাওয়ার পর হঠাৎ বমি, বুক ধড়ফড়, মাথা ঘোরা শুরু হলে বিষক্রিয়ার লক্ষণ হতে পারে।
বিষযুক্ত খাবার খেলে হঠাৎ শরীরে ঘাম হওয়া বা শীতল অনুভব হওয়া একধরনের প্রতিক্রিয়া।
ফরমালিনযুক্ত খাবারে সহজে পচন ধরে না। কয়েকদিন রেখে দিলে পচন না ধরলে সেটি সন্দেহজনক।
রান্নার সময় যদি খাবার থেকে কেমিক্যালজাত গন্ধ আসে, তবে সাবধান হন।
দুধ, ঘি বা দইয়ে সাবানমিশ্রিত ফেনা উঠলে বুঝতে হবে তা ভেজাল।
চিনিতে অতিরিক্ত মিষ্টি বা খটখটে স্বাদ থাকলে সেখানে রাসায়নিক থাকতে পারে।
খুব সহজ কিছু উপায়ে বাসায় বসেই খাবারে বিষ আছে কি না তা পরীক্ষা করা সম্ভব। নিচে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘরোয়া পরীক্ষার কৌশল দেওয়া হলো:
মাছ বা মাংস রান্নার সময় কাটা পেঁয়াজ দিলে তা যদি কালো হয়ে যায়, তবে বুঝতে হবে সেখানে ফরমালিন বা অন্যান্য বিষাক্ত উপাদান থাকতে পারে।
একটি সাদা কাপড় বা রুমাল দুধে ভিজিয়ে রোদে শুকাতে দিন। যদি কাপড়ের রঙ পরিবর্তন হয় (হলুদ, বাদামি, ছোপ ছোপ), তবে দুধে রাসায়নিক মিশ্রণ রয়েছে।
এক ফোঁটা হাইড্রোক্লোরিক এসিড বা পাতিলেবুর রস দিয়ে দেখুন – যদি লাল বা গাঢ় রঙে পরিবর্তন হয়, তবে তাতে সীসা ক্রোমেট থাকতে পারে।
পানিতে ডিম ডুবিয়ে দিন। যদি ডিম ভেসে উঠে, তবে সেটি পুরনো বা কৃত্রিমভাবে সংরক্ষিত।
কিছু পরিমাণ চাল বা ডাল পানিতে ভিজিয়ে ২-৩ ঘন্টা রাখুন। যদি পানি রঙ পরিবর্তন করে বা তীব্র গন্ধ আসে, তবে তাতে বিষ থাকতে পারে।
যদিও ঘরোয়া উপায়ে অনেক কিছু অনুমান করা যায়, তবে নিশ্চিত হতে হলে কিছু বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার দরকার হয়:
সাধারণত ফরমালিন টেস্টিং কিট দ্বারা মাছ বা ফলমূল পরীক্ষা করা যায়। রং পরিবর্তনের ভিত্তিতে শনাক্ত করা হয়।
কার্বাইড টেস্ট কিট বা ল্যাব পরীক্ষার মাধ্যমে ফল পাকানোয় কৃত্রিম উপাদান আছে কি না নির্ণয় করা যায়।
এই আধুনিক যন্ত্রের মাধ্যমে খাদ্যে বিষাক্ত ধাতব উপাদান বা রাসায়নিক চিহ্নিত করা হয়।
ফুড ল্যাবে পরীক্ষা করে বোঝা যায় কোনো খাবারে সালমোনেলা, ই.কোলাই বা অন্যান্য ব্যাকটেরিয়া আছে কি না।
খাদ্য কেনার সময় কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় খেয়াল রাখলে আপনি নিরাপদ থাকতে পারেন:
অতিরিক্ত উজ্জ্বল রঙের খাবার পরিহার করুন
ফল বা সবজি কাটার দাগ, গন্ধ ইত্যাদি খেয়াল করুন
মাছের চোখ ও আঁশ ঝরানো অংশ লক্ষ্য করুন
তাজা দুধ/ঘি হলে সেটি ঘন বা দানা দানা হবে
বেশি চকচকে মিষ্টি বা জিলাপি থেকে দূরে থাকুন
বিষক্রিয়ার লক্ষণ
খাবারে বিষক্রিয়া হলে শরীরে তাৎক্ষণিক কিছু লক্ষণ দেখা দেয়:
বমি বমি ভাব
পেটে ব্যথা বা গ্যাস
মাথা ঘোরা
হঠাৎ ঘাম হওয়া
হাত-পা দুর্বল হওয়া
জিভে জ্বালা
ত্বকে র্যাশ
শ্বাসকষ্ট
এই লক্ষণ দেখা দিলে অবিলম্বে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
বিষাক্ত খাবার খেলে যা করবেন:
রোগীকে দ্রুত বিশ্রামে রাখুন
ঠান্ডা পানি পান করান (অতিরিক্ত না)
প্রয়োজনে লবণ পানি খাইয়ে বমি ঘটানো যায়
ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ খাবেন না
দ্রুত নিকটস্থ হাসপাতাল বা হেলথ সেন্টারে নিয়ে যান
বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার বিভিন্ন আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে:
এই আইনে বলা হয়েছে – কোনো ব্যক্তি যদি ভেজাল বা বিষাক্ত খাদ্য বাজারজাত করে, তার বিরুদ্ধে শাস্তি মূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের জন্য নির্ধারিত মান এবং অনুমোদন থাকতে হয়।
নিয়মিতভাবে র্যাব ও প্রশাসন বাজারে অভিযান চালিয়ে ভেজাল খাদ্য উদ্ধার করে থাকে।
স্বাস্থ্যই সম্পদ। তাই আপনি ও আপনার পরিবারকে বিষাক্ত খাবার থেকে রক্ষা করতে হলে সচেতন হোন:
শুধু স্বাদ নয়, খাদ্যের উৎস জানুন
বাজার থেকে কিনে খাদ্য ধুয়ে রান্না করুন
সংরক্ষণের নিয়ম মেনে চলুন
স্থানীয় কৃষকদের উৎসাহ দিন
অর্গানিক বা ভেরিফায়েড উৎস থেকে কিনুন
নিচের পরীক্ষাগুলোও আপনি বাসায় বসেই করতে পারেন, যা অনেকাংশে বিষাক্ততা শনাক্তে সহায়তা করতে পারে:
কিছু চাল কড়াইতে ভেজে দেখুন। যদি প্লাস্টিকের গন্ধ আসে বা গলে যায়, তবে বুঝবেন সেটি কৃত্রিম বা ভেজাল চাল।
টমেটোর গায়ে অতিরিক্ত চকচক ভাব থাকলে তা পেট্রোলিয়াম দিয়ে ঘষা হতে পারে।
আপেলে কাপড় দিয়ে ঘষলে যদি তেলতেলে ভাব আসে, বুঝবেন কৃত্রিম চকচক ভাব দেওয়া হয়েছে।
সাধারণ লবণে পাথরের দানা বা অস্বাভাবিক গন্ধ থাকলে তাতে ক্যালসিয়াম কার্বাইড বা ফ্লোরাইড থাকতে পারে।
কিডনি, লিভার, এবং ফুসফুসের ক্ষতি করে
ক্যানসারের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে
শিশুদের মানসিক বিকাশ ব্যাহত করে
মাথা ব্যথা, তন্দ্রাচ্ছন্নতা ও পেটের সমস্যা
দীর্ঘমেয়াদে স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি করে
ত্বকে অ্যালার্জি
হরমোন ভারসাম্য নষ্ট করে
দীর্ঘমেয়াদে ক্যানসার
বুদ্ধিমত্তা হ্রাস করে
শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে বাধা
শিশুরা বিষাক্ত খাবারের প্রতি বেশি সংবেদনশীল।
ইমিউন সিস্টেম দুর্বল থাকায় দ্রুত অসুস্থ হয়।
প্রসেসড বা প্যাকেটজাত খাবার যতটা সম্ভব এড়ানো উচিত।
বৃদ্ধদের শরীরে বিষক্রিয়ার লক্ষণ দ্রুত দেখা দেয়।
যাদের ডায়াবেটিস বা হাইপারটেনশন আছে, তাদের জন্য বিষাক্ত খাবার মারাত্মক হতে পারে।
"প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী প্রায় ৬ লাখ মানুষ খাদ্য-সম্পর্কিত রোগে মারা যায়।"
উন্নয়নশীল দেশে ৭৫% মানুষ বিষাক্ত বা ভেজাল খাদ্য খেয়ে আক্রান্ত হয়।
দক্ষিণ এশিয়ায় শিশুদের ৪০% অপুষ্টির কারণ বিষাক্ত খাবার।
গবেষণায় প্রমাণিত যে, প্রাকৃতিক খাদ্যের তুলনায় রঙ/রসায়ন মেশানো খাদ্য খেলে ক্যানসারের আশঙ্কা ৩০% বাড়ে।
স্থানীয় খামার বা উৎস চিনে কেনা
BSTI বা নিরাপদ লেবেল দেখা
বিশুদ্ধ পানিতে ধুয়ে রান্না করা
রাসায়নিক মুক্ত উপাদান ব্যবহার
প্রিজারভেটিভ ছাড়া পণ্য পছন্দ করা
কাঁচা খাবার সাবধানে ধোয়া
আমরা যদি সবাই মিলে সচেতন না হই, তবে খাদ্য বিষক্রিয়ার প্রভাব আরও ভয়াবহ হবে। নিচের বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করুন:
স্কুল-কলেজে সচেতনতা কার্যক্রম চালানো
সামাজিক মাধ্যমে প্রচারণা চালানো
স্থানীয় দোকানদারদের প্রশিক্ষণ দেওয়া
আইন প্রয়োগে সহায়তা করা
[National Food Safety Policy - Bangladesh]
[Stanford University - Food Toxicology Research, 2022]
[ICDDR,B Food Safety Unit]
খাবারে বিষাক্ততা নির্ণয় ও তা থেকে রক্ষা পাওয়ার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হচ্ছে সচেতনতা। শুধু রাষ্ট্র নয়, বরং ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ—সবার সম্মিলিত চেষ্টায়ই গড়ে উঠবে একটি নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থা।
আমরা প্রতিদিন কী খাচ্ছি, সেটি জানার অধিকার আমাদের আছে। তাই নিজে জানুন, অন্যকে জানান, নিরাপদ খাবার খেয়ে সুস্থ থাকুন।
Copyright © NRS IT 2025