টিকটকে ভাইরাল সান্ডা খাওয়া ট্রেন্ড: ইসলামে কি এটি হালাল না হারাম এবং সমাজে এর ক্ষতিকর দিক নিয়ে বিশ্লেষণ
ভিউ: ৫৯
পোস্ট আপডেট ১৯ মে ২০২৫ ৪ ঘন্টা আগে
সম্প্রতি টিকটকসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে “সান্ডা” খাওয়ার ভিডিও ভাইরাল হয়ে উঠেছে। অনেকে এটিকে সাহসিকতা কিংবা অদ্ভুত খাদ্য অভ্যাস হিসেবে উপস্থাপন করছে। কিন্তু এই প্রবণতা শুধু ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকেই নয়, স্বাস্থ্যগত এবং সামাজিক দিক থেকেও গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।
এই প্রতিবেদনে আলোচনা করা হবে:
ইসলামে সান্ডা খাওয়া হালাল না হারাম
নবিজির (স.) জীবনে এর উল্লেখ
স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি ও বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ
টিকটকের প্রভাব ও সামাজিক ক্ষতি
ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে দায়িত্বশীলতা
সান্ডা, যাকে ইংরেজিতে Monitor Lizard বলা হয়, একটি সরীসৃপ প্রাণী যা দক্ষিণ এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা যায়। এটি সাধারণত শুকনো ও বালুময় এলাকায় বাস করে এবং দ্রুতগতিতে দৌড়াতে পারে। কেউ কেউ দাবি করে এর তেলের রয়েছে চিকিৎসাগত গুণাবলি, যদিও বৈজ্ঞানিকভাবে এর বেশিরভাগই প্রমাণহীন।
সান্ডা হলো একটি বড় আকারের সরীসৃপ (reptile) প্রাণী, যাকে ইংরেজিতে বলা হয় Monitor Lizard। এটি Varanidae পরিবারভুক্ত প্রাণী। এদের বৈশিষ্ট্য হল—দীর্ঘ লেজ, শক্তিশালী থাবা, চওড়া জিভ এবং সরু চোখ। এটি দেখতে অনেকটা ছোট কুমিরের মতো হলেও এটি আসলে কুমির নয়।
শ্রেণী | তথ্য |
রাজ্য (Kingdom) | Animalia |
পর্ব (Phylum) | Chordata |
বর্গ (Class) | Reptilia |
পরিবার (Family) | Varanidae |
গণ (Genus) | Varanus spp |
সাধারণ নাম | Spiny-tailed Lizard (সান্ডা) |
সান্ডা মূলত দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, আফ্রিকা, এবং অস্ট্রেলিয়া অঞ্চলে বেশি দেখা যায়।
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে, বিশেষ করে রাজশাহী, চট্টগ্রাম, সিলেট ও পার্বত্য এলাকায় এদের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়।
বনজঙ্গল
পাহাড়ি অঞ্চল
বালুময় এলাকা
খাল-বিল ও জলাশয়ের আশপাশ
সান্ডা সাধারণত মাংসাশী (Carnivore) প্রাণী। তারা নানান ধরনের ছোট প্রাণী খেয়ে থাকে।
ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী (ইঁদুর, খরগোশ)
পাখির ডিম
পোকামাকড়
মাছ
মৃত প্রাণী (Carrion)
গুরুত্বপূর্ণ: সান্ডা কখনও কখনও মৃত প্রাণী বা আবর্জনা খেয়েও জীবনধারণ করে — যার কারণে এদের শরীরে অনেক ধরনের বিষাক্ত ব্যাকটেরিয়া ও প্যারাসাইট থাকতে পারে।
বিশ্বে প্রায় ৮০টির বেশি প্রজাতির মনিটর লিজার্ড রয়েছে। এর মধ্যে কিছু বিখ্যাত প্রজাতি হলো:
কমোডো ড্রাগন (Komodo Dragon) – পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মনিটর লিজার্ড (ইন্দোনেশিয়ায়)
Bengal Monitor (Varanus bengalensis) – বাংলাদেশ ও ভারতে দেখা যায়
Water Monitor (Varanus salvator) – জলাশয়ের কাছে বাস করে
Desert Monitor – মরুভূমিতে দেখা যায়
অনেক এলাকায় প্রচলিত রয়েছে যে:
সান্ডার তেলে যৌন শক্তি বাড়ে – এটি একেবারেই ভিত্তিহীন এবং বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত নয়।
সান্ডা খেলে বিশেষ রোগ ভালো হয় – এই ধারণাও ভুল ও ক্ষতিকর, বরং এটি বিপদ ডেকে আনতে পারে।
বাংলাদেশে অনেক লোক "সান্ডার তেল" বাজারে বিক্রি করেন যৌন রোগের চিকিৎসার নামে, যা সম্পূর্ণ প্রতারণামূলক।
সাধারণভাবে সান্ডা আক্রমণাত্মক নয়। তবে ভয় পেলে বা বিপদের আশঙ্কা করলে এটি তীব্র কামড় দিতে পারে।
এছাড়া এদের লেজ দিয়ে মারতে পারে, যা বেশ ব্যথাদায়ক হতে পারে।
বাংলাদেশে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনে সান্ডা সংরক্ষিত প্রাণী হিসেবে চিহ্নিত।
যেকোনোভাবে হত্যা, ধরা, পাচার বা খাওয়া আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।
বিষয় | তথ্য |
ইংরেজি নাম | Spiny-tailed Lizard |
বৈজ্ঞানিক নাম | Uromastyx spp. |
বাংলাদেশে পাওয়া যায় | খুব কম পাওয়া যায়, প্রধানত মরুভূমি কিংবা শুষ্ক অঞ্চলে বেশি থাকে |
খাদ্যাভ্যাস | প্রধানত উদ্ভিদভক্ষী (Herbivore) |
মানুষের জন্য নিরাপদ? | সাধারণত নিরাপদ, তবে ধরে রাখা বা খাওয়া নিরাপদ নয় |
ইসলামে অবস্থান | সরাসরি উল্লেখ নেই, তবে সাধারণ শরীয়ত অনুযায়ী সরীসৃপ খাওয়া বর্জনীয় |
স্বাস্থ্য ঝুঁকি | সংক্রমণ ও এলার্জি হতে পারে যদি খাওয়া হয় |
আইনগত অবস্থা | সংরক্ষিত প্রাণী, হত্যা বা বিক্রি আইনত দণ্ডনীয় |
কিছু টিকটকার এবং লোকাল ইউটিউবার "সান্ডা ধরার", "সান্ডা কাটার", "সান্ডা রান্নার", এমনকি খাওয়ার ভিডিও আপলোড করতে শুরু করেন।
এসব ভিডিওতে বলা হয় — “সান্ডার মাংস ও তেল খেলে যৌন শক্তি বাড়ে”, “গোপন রোগ নিরাময় হয়”, ইত্যাদি।
ভিডিওগুলোর শিরোনাম হয়:
“সান্ডা খেয়ে ৭ দিনে শক্তিশালী হন!”
“সান্ডা রান্না করে খেলাম – বিশ্বাস না হলে দেখুন!”
“প্রাচীন ঔষধি খাবার – সান্ডা রান্না রেসিপি!”
এমন শিরোনাম সাধারণ মানুষের কৌতূহল ও লজ্জার বিষয়গুলোর সুযোগ নেয়।
অনেকেই আশ্চর্য হয়ে ভিডিও দেখেন, কেউ কেউ মজা করে শেয়ার করেন, কেউ আবার মিথ্যা বিশ্বাস করে উৎসাহিত হন।
কেউ কেউ ট্রেন্ডের অংশ হিসেবে নিজেরাও একই ধরনের ভিডিও বানিয়ে ফেলেন।
কিছু স্থানীয় হাকিম বা কবিরাজ টাইপের ব্যক্তি দাবি করেন,
“সান্ডার তেল লাগালে যৌন দুর্বলতা কমে যায়” — যা বিজ্ঞানসম্মত নয়।
অনেকে ভিডিওতে দেখান, তারা সান্ডার তেল ঘরে তৈরি করছেন – অথচ তা বিপজ্জনক ও ভুয়া।
টিকটক ও ইউটিউবে “ট্রেন্ড” এ চড়ার জন্য অনেকে ইচ্ছাকৃতভাবে সান্ডার ভিডিও বানায়, কারণ তারা জানে—
অদ্ভুত জিনিস ভাইরাল হয়
যৌন-সম্পর্কিত ট্যাগ দ্রুত ছড়ায়
মানুষের সহজ বিশ্বাস ভিডিওর ভিউ বাড়ায়
দিক | ক্ষতি |
স্বাস্থ্য | সংক্রমণ (Salmonella, Parasite), বিষক্রিয়া, খাদ্যে বিষ |
ধর্মীয় বিভ্রান্তি | ইসলামে হারাম না হলেও, রাসূল (সা.) নিজে সান্ডা খাননি – অথচ ভিডিওগুলোতে এটি "সুন্নত খাবার" বলে চালানো হয় |
পরিবেশ | সংরক্ষিত প্রাণী ধ্বংস হওয়া, প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট |
আইন | বন্যপ্রাণী আইনে অপরাধ হওয়া সত্ত্বেও ভিডিও তৈরি ও প্রচার করা |
সমাজ | যৌন দুর্বলতা নিয়ে ভয়ভীতি ছড়ানো, ভুয়া চিকিৎসা তথ্য ছড়ানো |
কোরআনে সরাসরি সান্ডা বা তার জাতীয় প্রাণীর উল্লেখ নেই, তবে আল্লাহপাক স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, সব ধরনের অপবিত্র ও ক্ষতিকর জিনিস থেকে বিরত থাকতে হবে।
“তোমরা উত্তম জিনিসগুলো আহার করো, যা আমি তোমাদের জন্য হালাল করেছি।”
— (সূরা বাকারা: ১৬৮)
হাদিস শরীফে স্পষ্টভাবে সান্ডা খাওয়ার প্রসঙ্গ এসেছে। সহিহ মুসলিম ও সহিহ বুখারি হাদিসে উল্লেখ আছে যে, রাসূলুল্লাহ (স.) সান্ডা খাননি, তবে তিনি তা হারামও বলেননি।
উদাহরণ:
ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন,
"আমার খালার ঘরে আমি রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সাথে খাচ্ছিলাম, হঠাৎ এক ধরনের প্রাণী (সান্ডা) আনল। তিনি তা খেতে অস্বীকৃতি জানালেন।"
— (সহিহ বুখারি: ২৫৭৫)
সিদ্ধান্ত:
ইসলামী স্কলারদের মতে, যেহেতু রাসূল (স.) নিজে খাননি কিন্তু নিষেধও করেননি — এটি মুবাহ অর্থাৎ খাওয়া যাবে, তবে না খেলেও কোনো পাপ নেই। তবে একে পছন্দনীয় খাবার বলা যাবে না।
বর্তমানে কিছু কনটেন্ট নির্মাতা ভাইরাল হওয়ার উদ্দেশ্যে “সান্ডা” কাঁচা খাওয়ার ভিডিও বানাচ্ছেন।
অনেকেই এটিকে অ্যাডভেঞ্চার বা সাহসিকতা বলে উপস্থাপন করছেন
বাস্তবে তারা প্রচার করছে এক বিকৃত মানসিকতা ও বিপজ্জনক স্বাস্থ্য ঝুঁকি
প্রাণী নির্যাতন:
সান্ডাকে জীবন্ত পুড়িয়ে বা কেটে খাওয়ার দৃশ্য দেখানো হয় যা পশু নির্যাতনের পর্যায়ে পড়ে।
শিশু-কিশোরদের মানসিক বিকৃতি:
যারা ভিডিও দেখে উৎসাহী হয়, তারা ভাবছে এটি স্বাভাবিক বিষয় — ফলে সমাজে বিকৃত খাদ্যাভ্যাস ও সহিংসতা বেড়ে যাচ্ছে।
ইসলামের অপব্যাখ্যা:
কেউ কেউ হাদিসের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে একে হালাল হিসেবে প্রচার করছে, যা ধর্মীয় ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি করছে।
Salmonella Infection
Parasitic Worms (প্যারাসাইট)
Reptile Borne Bacteria
টক্সিন ও বিষাক্ত পদার্থের সম্ভাবনা
WHO বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানায়, বন্য প্রাণী খাওয়া সংক্রমণ ছড়ানোর একটি বড় উৎস।
মনিটর লিজার্ড (সান্ডা) তেমন একটি প্রাণী, যেটি গৃহপালিত নয় এবং প্রাকৃতিকভাবে পরিচ্ছন্ন নয়।
কনটেন্ট নির্মাতাদের দায়িত্ব:
ইসলামে অন্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করা বা বিভ্রান্ত করা হারাম।
"তোমাদের মধ্যে কেউ যদি কোনো অন্যায় দেখে, সে যেন তা হাত দিয়ে বন্ধ করে..."
— (সহিহ মুসলিম)
অভিভাবকদের ভূমিকা:
সন্তানরা টিকটকে কী দেখছে, তা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা উচিত।
ইসলামী দাওয়াত কার্যক্রম:
মসজিদ ও ইসলামিক সেমিনারে এ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
হালাল ও পরিচ্ছন্ন খাবার গ্রহণ
অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া
সামাজিক মাধ্যমে দায়িত্বশীল ব্যবহার নিশ্চিত করা
ইসলামী শরীয়ার আলোকে খাদ্য তালিকা নির্ধারণ
সান্ডা খাওয়া বিষয়টি ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে নিষিদ্ধ না হলেও একে উৎসাহিত করা ইসলামী রুচির পরিপন্থী।
বর্তমানে টিকটকের মত প্ল্যাটফর্মে এই বিষয়ে ভাইরাল ভিডিও বানিয়ে ধর্ম ও স্বাস্থ্যকে উপেক্ষা করা হচ্ছে, যা সমাজে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। আমাদের উচিত—বিকৃতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া এবং স্বাস্থ্যবান, ধর্মপরায়ণ জীবন গড়ে তোলা।
Copyright © NRS IT 2025