২১ মে আন্তর্জাতিক চা দিবস: জানুন ইতিহাস, উৎপত্তি, গুরুত্ব এবং বিশ্বজুড়ে চা শিল্পের অবদান ও বাংলাদেশের অবস্থান।
ভিউ: ১০৩
পোস্ট আপডেট ২০ মে ২০২৫ ২ দিন আগে
চা — এই একটি শব্দই অনেকের সকাল শুরু করে, আবার অনেকের সন্ধ্যার গল্প। বিশ্বজুড়ে এই পানীয়টি যেমন জনপ্রিয়, তেমনি এর পেছনে রয়েছে একটি সমৃদ্ধ ইতিহাস ও অর্থনৈতিক প্রভাব। প্রতিদিন পৃথিবীর প্রায় ৩০০ কোটির বেশি কাপ চা পান করা হয়। এই চা নিয়ে শ্রদ্ধা ও সচেতনতা তৈরির জন্যই প্রতি বছর ২১ মে ‘আন্তর্জাতিক চা দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়।
আন্তর্জাতিক চা দিবসের সূচনা
আন্তর্জাতিক চা দিবস প্রথম পালন শুরু হয় ২০০৫ সালে ভারতে, চা শ্রমিকদের অধিকার ও চা শিল্পের উন্নয়নের লক্ষ্যে। পরবর্তীতে জাতিসংঘ ২০১৯ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ২১ মে দিনটিকে ‘আন্তর্জাতিক চা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। বিশেষ করে ভারতের চেন্নাই, কলকাতা, ডার্জিলিং, এবং শ্রীলঙ্কা, নেপাল, বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া সহ দক্ষিণ এশিয়ার চা উৎপাদনকারী দেশগুলোতে চা শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ১৫ ডিসেম্বর দিনটি প্রথম পালন করা হয়।
প্রাথমিক পর্যায়ে এই দিবসের মূল উদ্দেশ্য ছিল:
চা শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি
শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা
চা বাজারে ন্যায্য বাণিজ্য নিশ্চিত করা
জাতিসংঘের স্বীকৃতি ও নতুন তারিখ
চা উৎপাদনে চীনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা, এবং চায়ের বৈশ্বিক প্রভাব বিবেচনায় এনে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO) এই উদ্যোগকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেয়।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে জাতিসংঘ ঘোষণা করে যে, প্রতি বছর ২১ মে তারিখে আন্তর্জাতিকভাবে ‘International Tea Day’ পালন করা হবে।
এই তারিখটি নির্ধারণের পেছনে একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো, ২১ মে অনেক দেশে চায়ের ফার্স্ট হারভেস্ট (প্রথম চয়ন) শুরু হয়—যা চা চাষের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সময়।
জাতিসংঘ ঘোষণার পর প্রথম আন্তর্জাতিক চা দিবস পালন করা হয় ২১ মে, ২০২০ সালে।
বিশ্বজুড়ে ভার্চুয়াল আলোচনাসভা, সচেতনতা ক্যাম্পেইন এবং চা শিল্পে নারীদের অবদান তুলে ধরাসহ নানা কার্যক্রমের মাধ্যমে দিবসটি উদযাপিত হয়।
দিবসটির প্রধান লক্ষ্য
এই দিবসের মূল উদ্দেশ্য হল – চা উৎপাদকদের অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়া, তাদের ন্যায্য পারিশ্রমিক নিশ্চিত করা এবং টেকসই চা শিল্প গড়ে তোলা।
চা উৎপাদন ও বৈশ্বিক প্রভাব
চা উৎপাদনে শীর্ষস্থানীয় দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে – চীন, ভারত, কেনিয়া, শ্রীলঙ্কা, এবং বাংলাদেশ। চা কেবলমাত্র একটি পানীয় নয়; এটি বহু দেশের অর্থনীতির বড় অংশ।
চায়ের ইতিহাস প্রায় ৫০০০ বছর পুরনো। খ্রিস্টপূর্ব ২৭৩৭ সালে চীনের সম্রাট শেন নুং যখন ফুটন্ত পানিতে একটি গাছের পাতা পড়ে যেতে দেখেন, তখনই প্রথম চায়ের জন্ম হয় বলে বিশ্বাস করা হয়। সেই থেকে চা চীনা সংস্কৃতির অপরিহার্য অংশ হয়ে দাঁড়ায়।
চীন থেকে জাপানে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের মাধ্যমে চা প্রবেশ করে। জাপানে ‘চা অনুষ্ঠান’ (Tea Ceremony) আজও একটি পবিত্র ও সাংস্কৃতিক আচার হিসেবে পালিত হয়।
ভারতে চা উৎপাদনের সূচনা হয় ব্রিটিশ শাসনামলে। আসাম ও দার্জিলিং অঞ্চলে ব্রিটিশরা চা চাষ শুরু করে। আজ ভারতের আসাম চা ও দার্জিলিং চা বিশ্ববিখ্যাত।
১৬শ শতকে চা ইউরোপে প্রবেশ করে। ইংল্যান্ডে চা এত জনপ্রিয় হয় যে ব্রিটিশ রাজপরিবারেও এটি একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে।
আন্তর্জাতিক চা দিবসের তাৎপর্য
চা দিবস মূলত চা বাগানের শ্রমিকদের অধিকার, স্বাস্থ্যসেবা, বাসস্থান ও ন্যায্য মজুরি নিশ্চিতে সচেতনতা তৈরি করে।
চা উৎপাদন প্রাকৃতিক আবহাওয়ার ওপর নির্ভরশীল। জলবায়ু পরিবর্তন চা উৎপাদনে বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। তাই টেকসই উৎপাদন পদ্ধতি গ্রহণ করা জরুরি।
চা কেবল পানীয় নয়, এটি হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, ক্যানসারের মতো রোগ প্রতিরোধে সহায়ক। গ্রীন টি, ব্ল্যাক টি ও হারবাল টি-এর রয়েছে আলাদা আলাদা উপকারিতা।
বাংলাদেশের চা শিল্প
বাংলাদেশে চা শিল্পের যাত্রা শুরু ব্রিটিশ আমলে, ১৮৪০ সালে সিলেটের মালনীছড়ায় প্রথম চা বাগান স্থাপন হয়। বর্তমানে সিলেট, মৌলভীবাজার, চট্টগ্রাম, পঞ্চগড়, রাঙ্গামাটি, বান্দরবানসহ দেশের ১৩টি জেলায় চা উৎপাদিত হয়।
বাংলাদেশ বর্তমানে বছরে প্রায় ৯ কোটি কেজি চা উৎপাদন করে। এর মধ্যে দেশীয় চাহিদা পূরণ করে বাকি অংশ বিদেশে রপ্তানি হয়।
বাংলাদেশ চা রপ্তানির মাধ্যমে বছরে কোটি কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে। চা শিল্প শুধু দেশীয় চাহিদা পূরণেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি দেশের রপ্তানি আয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত হিসেবে বিবেচিত। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের চা পণ্যের চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে, যার মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব হচ্ছে এবং দেশের অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যুক্ত হচ্ছে।
বাংলাদেশ ১৯৫৭ সাল থেকেই আন্তর্জাতিক বাজারে চা রপ্তানি শুরু করে। একসময় বাংলাদেশ ছিল বিশ্বের শীর্ষ চা রপ্তানিকারক দেশগুলোর মধ্যে একটি। যদিও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চা উৎপাদন দেশীয় চাহিদা মেটাতেই ব্যস্ত হয়ে পড়ে, তবে সম্প্রতি চা উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধির ফলে রপ্তানি সম্ভাবনা আবার জোরালো হয়েছে।
বিশেষ করে চীন, পাকিস্তান, রাশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব এবং ইউরোপের কয়েকটি দেশে বাংলাদেশের চায়ের চাহিদা রয়েছে।
বাংলাদেশের চা শিল্পে নারী শ্রমিকদের ভূমিকা অনন্য। শতকরা ৭০ ভাগ শ্রমিকই নারী। চা শিল্পের অগ্রগতির পেছনে এক বিশাল ভূমিকা পালন করছেন চা বাগানে কর্মরত নারী শ্রমিকরা।
এই শিল্পের সফলতা, উৎপাদন বৃদ্ধি এবং রপ্তানি সক্ষমতার মূল চালিকাশক্তি বলা চলে এসব পরিশ্রমী নারীদের, যারা প্রতিদিন ভোর থেকে শুরু করে সন্ধ্যা পর্যন্ত চা পাতা তোলাসহ নানা কাজ করেন। তাদের অবদান শুধু শ্রমিক হিসেবে নয়, পুরো অর্থনীতিতেই এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।নারী শ্রমিকদের অক্লান্ত পরিশ্রম ছাড়া বাংলাদেশের চা শিল্প কখনোই বর্তমান অবস্থানে পৌঁছাতে পারত না। তাদের সম্মান, ন্যায্য মজুরি ও সুরক্ষিত কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। তারা কেবল শ্রমিক নয়, এই শিল্পের প্রকৃত চালিকাশক্তি—বাংলাদেশের চা-বিজয়ের নীরব নায়িকা।
চায়ের বিভিন্ন ধরণ রয়েছে, প্রতিটির আলাদা স্বাদ, স্বাস্থ্যগুণ ও প্রস্তুতির ধরন রয়েছে। নিচে প্রধান কয়েকটি ধরন উল্লেখ করা হলো:
সর্বাধিক ব্যবহৃত চা।
ক্যাফেইনের মাত্রা বেশি।
শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ।
ওজন কমাতে সহায়ক।
অ্যান্টি-এজিং বৈশিষ্ট্য রয়েছে।
হৃদরোগ প্রতিরোধ করে।
সবচেয়ে হালকা ও প্রাকৃতিক চা।
উচ্চ অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে।
এটি মূলত ভেষজ উদ্ভিদ, ফুল ও শেকড় থেকে তৈরি।
ক্যাফেইন থাকে না।
যেমন: ক্যামোমাইল, তুলসী, লেমন গ্রাস।
কালো ও সবুজ চায়ের মাঝামাঝি।
বিশেষ করে চীনা সংস্কৃতিতে জনপ্রিয়।
চা শুধু পানীয় নয় – এটি প্রাকৃতিক ওষুধের মতো কাজ করে । চায়ে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যেমন ক্যাটেচিন ও পলিফেনল, দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সহায়ক। এটি ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ও ফ্রি-র্যাডিকেলের ক্ষতি থেকে শরীরকে রক্ষা করে। বিশেষ করে গ্রীন টি ও হারবাল টি ঠান্ডা, কাশি ও সর্দির মতো সংক্রমণে কার্যকর। নিয়মিত চা পান শরীরকে সুস্থ ও রোগমুক্ত রাখতে সাহায্য করে।
বিশেষ করে গ্রীন টি বা সবুজ চা শরীরের অতিরিক্ত চর্বি বার্ন করতে সাহায্য করে। এতে রয়েছে Catechins (বিশেষ করে EGCG) নামক একটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা মেটাবলিজম বৃদ্ধি করে।
গ্রীন টি শরীরের ফ্যাট অক্সিডেশন বৃদ্ধি করে।
ইনসুলিন সেনসিটিভিটি বাড়িয়ে গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণে রাখে।
প্রাকৃতিকভাবে ক্ষুধা কমায়, ফলে অপ্রয়োজনীয় ক্যালোরি গ্রহণ কম হয়।
নিয়মিত ব্যায়ামের সঙ্গে সবুজ চা পান ওজন কমাতে কার্যকর প্রমাণিত।
সকালে খালি পেটে ১ কাপ গরম গ্রীন টি পান করা সবচেয়ে উপকারী।
২. হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়
চা, বিশেষ করে ব্ল্যাক টি ও গ্রীন টি, হৃদযন্ত্রের সুস্থতায় কার্যকর। এতে রয়েছে ফ্ল্যাভোনয়েডস, যা রক্তনালীতে ফ্লাক জমা প্রতিরোধ করে এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে।
LDL (খারাপ কোলেস্টেরল) হ্রাস করে।
HDL (ভালো কোলেস্টেরল) বাড়ায়।
রক্ত চলাচল স্বাভাবিক রাখে, যা হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা কমায়।
রক্তে ট্রাইগ্লিসারাইড ও ব্লাড প্রেসার কমায়।
দুধ ও চিনি ছাড়া চা পান করলে এই উপকারিতা সবচেয়ে বেশি হয়।
৩. স্ট্রেস বা মানসিক চাপ কমায়
চায়ের মধ্যে থাকা Theanine (থিয়ানিন) নামক একটি অ্যামিনো অ্যাসিড মস্তিষ্কে ডোপামিন এবং সেরোটোনিনের মাত্রা বাড়ায়, যা মানসিক প্রশান্তি এনে দেয়।
মস্তিষ্কে আলফা ওয়েভ উৎপাদন বাড়ায়, যা রিলাক্সেশন সৃষ্টি করে।
কর্মস্থলে চাপের মধ্যে এক কাপ চা মনের প্রশান্তি দেয়।
দীর্ঘ সময় মনোযোগ ধরে রাখতে সহায়ক – ছাত্রছাত্রী ও পেশাজীবীদের জন্য আদর্শ।
চিন্তা বা উদ্বেগের সময় গরম এক কাপ চা মন শান্ত করে এবং কর্মক্ষমতা বাড়ায়।
৪. হজমে সহায়ক
চা, বিশেষ করে পুদিনা, আদা বা লেমন গ্রাস চা, হজম শক্তি বাড়াতে ও গ্যাস্ট্রিক সমস্যা কমাতে দারুণ কার্যকর।
খাবার পর ১ কাপ চা গ্যাস ও অম্বল দূর করে।
বাইল (পিত্তরস) নিঃসরণ বাড়িয়ে ফ্যাট হজমে সহায়তা করে।
দ্রুত খাদ্য পরিপাক ঘটায়, যার ফলে বমি ভাব বা ডায়রিয়ার ঝুঁকি কমে।
আদা চা বমিভাব ও হালকা জ্বরেও উপকারী।
খাবার পর গরম ভেষজ চা বা লেবু-চা হজমে সহায়ক।
৫. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়
চায়ের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যেমন পলিফেনল, ফ্ল্যাভোনয়েডস, ক্যাটেচিনস শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করে।
বাকটেরিয়া ও ভাইরাস প্রতিরোধে সহায়ক।
ঠান্ডা, সর্দি, কাশি প্রতিরোধে সাহায্য করে।
রোগজীবাণু নাশক উপাদান থাকে চায়ের পাতায়।
হারবাল টি (তুলসী, আদা) প্রাকৃতিক অ্যান্টিবায়োটিকের কাজ করে।
প্রতিদিন ২–৩ কাপ চা শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে সজীব রাখে।
জাতিসংঘ FAO, WTO ও অন্যান্য সংগঠন এই দিন উপলক্ষে চা উৎপাদকদের নিয়ে ওয়েবিনার ও আলোচনার আয়োজন করে।
বিভিন্ন দেশে চা উৎসব, প্রদর্শনী, চায়ের প্রদর্শনী ও চাষিদের সম্মাননা প্রদান করা হয়।
বাংলাদেশ চা বোর্ড ও চা গবেষণা প্রতিষ্ঠান এই দিবস উদযাপনে আয়োজন করে সেমিনার, র্যালি ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিশেষ অনুষ্ঠান ও প্রতিবেদন প্রচার করা হয়।
চা বাগানের শ্রমিকদের জন্য আয়োজিত হয় পুরস্কার ও খাবারের ব্যবস্থা।
Copyright © NRS IT 2025