শিক্ষা ব্যবস্থার সুষ্ঠু তদারকির জন্য পর্যাপ্ত জনবল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে ৭৩২টি বিদ্যালয়ের তদারকির দায়িত্ব পালন করছেন মাত্র ১৪ জন কর্মকর্তা।
ভিউ: ১০৭
পোস্ট আপডেট ০৭ জানুয়ারী ২০২৫ ৪ মাস আগে
লক্ষ্মীপুর জেলায় সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার ঘাটতি প্রাথমিক শিক্ষার মানের উপর গভীর প্রভাব ফেলছে। জেলায় ৭৩২টি বিদ্যালয়ের তদারকির দায়িত্ব মাত্র ১৪ জন কর্মকর্তার উপর নির্ভরশীল, যা কার্যক্রম পরিচালনায় চরম অপ্রতুল। এর ফলে বিদ্যালয়গুলোর কার্যক্রম যথাযথভাবে মনিটরিং করা সম্ভব হচ্ছে না, এবং এই অভাব শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার মানে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
অভিভাবকেরা এই পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এবং যথাযথ তদারকির অভাবে শিক্ষার মান আরো নিম্নমুখী হওয়ার আশঙ্কা করছেন। তদারকির অভাবের কারণে বিদ্যালয়ের উপস্থিতি, পাঠদানের মান এবং শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
এই সংকট মোকাবিলায় দ্রুত নতুন কর্মকর্তা নিয়োগ ও তদারকি কার্যক্রম জোরদার করার পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। এর পাশাপাশি বিদ্যমান কর্মকর্তাদের উপর কাজের চাপ কমাতে প্রযুক্তি-নির্ভর সমাধান ও সহায়ক কর্মী নিয়োগের বিষয়টিও বিবেচনা করা যেতে পারে।
লক্ষ্মীপুর জেলায় সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার ঘাটতি পরিস্থিতি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। জেলায় ৩৩টি পদের বিপরীতে বর্তমানে ১৪ জন কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করছেন, অর্থাৎ ১৯টি পদ দীর্ঘ ৮ থেকে ১০ বছর ধরে শূন্য রয়েছে। এর মধ্যে শুধু সদর উপজেলায় ১০টি পদ খালি।
এই ঘাটতির কারণে, গড়ে প্রতি কর্মকর্তাকে ৫২টি বিদ্যালয়ের দায়িত্ব নিতে হচ্ছে। নিয়ম অনুযায়ী, একজন কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে সর্বোচ্চ ২০ থেকে ২৫টি বিদ্যালয় থাকা উচিত। কিন্তু এই অপ্রতুলতা কর্মকর্তাদের উপর অস্বাভাবিক চাপ তৈরি করছে।
উল্লেখ্য, প্রতিদিন একটি বিদ্যালয় পরিদর্শন করলে, একজন কর্মকর্তাকে নিজের দায়িত্বাধীন সব বিদ্যালয় পরিদর্শন শেষ করতে আড়াই মাস সময় লাগবে। এতে বিদ্যালয়গুলোর নিয়মিত মনিটরিং কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
লক্ষ্মীপুর জেলার প্রাথমিক শিক্ষার তদারকিতে সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তার সংকট একটি গুরুতর সমস্যা হিসেবে উঠে এসেছে। ৭৩২টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রায় চার লাখ শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে। তবে এসব বিদ্যালয় তদারকির জন্য প্রয়োজনীয় ৩৩টি পদের মধ্যে ১৯টি দীর্ঘ ৮ থেকে ১০ বছর ধরে শূন্য রয়েছে।
লক্ষ্মীপুর জেলার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তার (এটিও) সংকটের প্রভাব নিয়ে প্রাক্তন শিক্ষক মো. আমির হোসেনের অভিজ্ঞতা অতীত ও বর্তমানের ব্যবস্থার মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্য তুলে ধরেছে।
তিনি উল্লেখ করেন যে, ১৫ বছর আগে যখন তিনি শিক্ষকতা করতেন, তখন সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তাদের উপস্থিতি শিক্ষকদের মধ্যে দায়িত্ববোধ ও শৃঙ্খলার পরিবেশ বজায় রাখত। কর্মকর্তারা যখন-তখন বিদ্যালয়ে এসে পরিদর্শন করতেন এবং অনিয়ম পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতেন। এ কারণে শিক্ষকরা সময়মতো বিদ্যালয়ে উপস্থিত থাকতেন এবং পাঠদানের প্রতি মনোযোগী হতেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রায়পুর উপজেলার কেরোয়া ইউনিয়নের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি জানান, তাঁর বিদ্যালয়ে প্রায় প্রতিদিনই শিক্ষকেরা এক থেকে দেড় ঘণ্টা দেরিতে আসেন। এই কারণে শিক্ষার্থীরা ক্লাস না করে মাঠে খেলাধুলায় সময় কাটায়। এই বিষয়টি নিয়ে তিনি শিক্ষকদের সঙ্গে বেশ কয়েকবার বাগ্বিতণ্ডা করেছেন, কিন্তু তাতে কোনো ফল হয়নি।
রামগঞ্জ উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি শেখ জাহাঙ্গীর আলম প্রথম আলোকে বলেন, বিদ্যালয়ের তুলনায় বর্তমানে তদারকির পদ খুবই কম। তার মতে, তদারকি ব্যবস্থা শক্তিশালী করা হলে বিদ্যালয়ের কার্যক্রমের গুণগত মান বৃদ্ধি পাবে।
তিনি আরও বলেন, "বাড়তি তদারকি থাকলে শিক্ষার মানও বাড়ে।" এই কারণে বিদ্যালয়গুলোর মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করা অত্যন্ত জরুরি। তিনি মনে করেন, তদারকি ছাড়া শিক্ষার উন্নয়ন সম্ভব নয় এবং এর কোনো বিকল্পও নেই।
রামগঞ্জে বর্তমানে কর্মরত সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা ফারহানা হক জানিয়েছেন, একজন সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা মাসে প্রায় ১০টি বিদ্যালয় পরিদর্শন করতে পারেন। তার মানে, সব বিদ্যালয় পরিদর্শন করতে ১০ থেকে ১১ মাস সময় প্রয়োজন। তবে, বিদ্যালয় পরিদর্শনের পাশাপাশি তাঁদের কার্যালয়ের অন্যান্য কার্যক্রমও করতে হয়, যা তদারকির কাজের ওপর চাপ তৈরি করে।
ফারহানা হক বলেন, যদি বিদ্যালয়গুলোতে তদারকি কমে যায়, তবে শিক্ষার মানোন্নয়ন কমে যাবে। এই কারণে, তিনি মনে করেন যে সরকারের মূল উদ্দেশ্য—শিক্ষার মান উন্নয়ন—ব্যাহত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাঁর মতে, তদারকি কার্যক্রম জোরদার করা না গেলে শিক্ষার গুণগত মান ধরে রাখা সম্ভব হবে না।
তিনজন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক জানান, পঞ্চম শ্রেণি থেকে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হওয়া অনেক ছাত্র-ছাত্রী গণিত ও ইংরেজিতে অত্যন্ত দুর্বল। অনেক ছাত্র-ছাত্রী এমনকি নিজের নামও ইংরেজিতে লিখতে পারে না। ফলে, এসব শিক্ষার্থীকে বিদ্যালয়ে পাঠদান করার সময় তাদের জন্য বিশেষ কষ্টকর হয়ে পড়ে।
শিক্ষকরা মনে করেন, এই সমস্যাগুলোর মূল কারণ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার মানের দুর্বলতা। তাদের মতে, তৃণমূল পর্যায়ের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করা জরুরি, যাতে শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক স্তরে সঠিক ভিত্তি পেতে পারে এবং মাধ্যমিক স্তরে উন্নত শিক্ষার সুযোগ পায়।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আবদুল লতিফ মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, “এটিওর সংকট দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে।” তিনি জানান, এই বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার জানানো হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে, ১৪ জন সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তার পক্ষে মাসে ৭৩২টি বিদ্যালয়ের মনিটরিং করা সম্ভব নয়।
তিনি আরও বলেন, "১ জন সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা ২০ থেকে ২৫টি বিদ্যালয়ের মনিটরিংয়ের জন্য নিয়োগ পাওয়ার নিয়ম রয়েছে, কিন্তু বর্তমান সংকটে বিদ্যালয় মনিটরিং কার্যক্রম যথাযথভাবে চালানো সম্ভব হচ্ছে না।" এর ফলে, বিদ্যালয়ের তদারকি কমে যাওয়ায় শিক্ষার মান উন্নয়নেও বাধা সৃষ্টি হচ্ছে, যা সরকারের মূল উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করছে।
Copyright © NRS IT 2025